"মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ
চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের
নীল
ছায়া বাংলার অপরূপ
রূপ
দেখিয়াছে।"
বাংলা মাতৃকার অপরূপ সাজের অন্যতম সঙ্গী হিজল গাছ। হিজল বনের সুসজ্জিত
ফুলের সৌন্দর্য মধুকর ডিঙা থেকে চাঁদ সদাগর দেখেছিল। চাঁদের দেখা এই হিজল বন
ময়ূরাক্ষী নদী ও দ্বারকা নদীর সংযোগস্থলে ১৩০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে মুর্শিদাবাদ
জেলার কান্দির অদূরে পূর্বদিকে অবস্থিত।
এলাকাটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঢালু। ছোটনাগপুর পাহাড় থেকে বয়ে আসা ময়ূরাক্ষী ও
দ্বারকা নদীর জল বর্ষাকালে প্লাবিত হয়ে বিলের সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে নদীর জলবাহিত
হিজল গাছের বীজ এসে এখানে জড়ো হয়ে হিজল বনের সৃষ্টি করেছিল সেই থেকে নাম হয় হিজল।
চিরসবুজ এই গাছগুলি সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হয়। পাতাগুলি অনেকটা কাঁঠাল পাতার
মতো। নাকছাবির মতো লাল লাল ফুলগুলি সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে ফোটে। বর্ষাকালে জলে
ডুবে থাকলেও সুন্দরী গাছে মতো এরা বেঁচে থাকতে পারে।
ফতেসিং পরগণার অন্তর্গত অঞ্চলটি সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ ছিল। “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসের কায়স্থ” খণ্ডে উল্লেখ আছে যে, এই অঞ্চল ছিল কায়স্থদের আদি আবাসস্থল। আনুমানিক খ্রিস্টীয় নবম শতকে কায়স্থদের হিজলে আগমন ঘটেছিল। উল্লেখ্য রাজা আদিশূর পাঁচজন কায়স্থকে কান্যকুব্জ থেকে বঙ্গে এনেছিলেন। সম্ভবত তাদের একজন হিজলে বসবাস শুরু করেন। মহারাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলে হিজল সহ সমগ্র রাঢ়বঙ্গে কায়স্থরা তাদের বসতি গড়ে তুলেছিলেন। চারদিকে নদী বেষ্টিত হওয়ায় কৃষিকাজের ও জলপথে যাতায়াতের সুবিধার জন্য স্থানটি বেছে নিয়েছিল তাঁরা।
এক সময় হিজল কান্দি জেমো ও বাগডাঙ্গা রাজাদের যৌথ খাজনা আদয়ের
অন্তর্ভূত এলাকা ছিল। ক্রমে সমগ্র অঞ্চলটি কয়েকটি জমিদারী মালিকানায় বিভক্ত হয়ে যায়। নদীর জল
যাতে প্লাবিত করতে না পারে তাই আপন আপন এলাকা মাটির বাঁধ বা ঘের দিয়ে ঘিরে নেয়।
যেমন- মাখনবাবুর ঘের,
সোনাডাঙা ঘের, ষোলোভাগি ঘের ইত্যাদি। তাই
হিজলকে অনেকে 'ঘের'ও বলে। এতে গরীব
চাষিদের জমিতে ফসল নষ্ট হতো। এই নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে বিবাদের সৃষ্টি হয়। বঙ্গের
প্রথম কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে এই এলাকা সম্পর্কিত।
স্বাধীনতার পরবর্তিকালে বাংলার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে অনেক জমি
সাধারণ মানুষের হাতে চলে আসে। সরকার জমির পাট্টা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়
এবং কৃষি সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। ক্রমে কায়স্থরা হিজল ছেড়ে উন্নত এলাকায় তাদের
বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেনির মানুষ বাস
করেন এখানে। মূলত চাষবাস,
পশুপালন ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। বর্ষার সময়
চারদিক জল বেষ্টিত দ্বীপের মতো হয়ে পড়েন
এখানকার বাসিন্দারা।
নদী আছে,
মাঠ আছে কিন্তু সেই নয়ন মুগ্ধকর রূপসী বাংলার সঙ্গী হিজল গাছ নেই।
বর্তমানে তাল, কুল, শিরিষ এই ধরণের
কিছু গাছ দেখা যায়। বর্ষা কম হলে কিছু কিছু জমিতে ধান চাষ হয়। বাঁধ ভেঙে আবার মাঝে
মাঝে প্লাবিত হয়। জল নামলে রবি শস্যের চাষ হয়।
তবে আশার কথা 'কান্দি মাস্টার প্ল্যান' প্রকল্পের অধীনে হিজলের
বাবলা বা দ্বারকা নদী ও তার শাখা কুয়ো নদীর উপর দুটি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। এরফলে
পূর্বে সাঁটুই ও পশ্চিমে কান্দির সঙ্গে হিজলের যোগাযোগের সুবিধা হবে। কিছুটা
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবে হিজলের হত দরিদ্র মানুষেরা। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট,
জমির সেঁচ ব্যবস্থার আধুনিকরণ
এবং নদী বাঁধের সঠিক মেরামত হলে হিজলের আর্থিক অবস্থার অনেকটা উন্নয়ন ঘটবে।
(
তথ্য সংগ্রহ ও লেখক : দীননাথ মণ্ডল )
No comments:
Post a Comment