মুর্শিদাবাদ জেলার সর্বোচ্চ মন্দির ডাহাপাড়ায় অবস্থিত। হাজারদুয়ারির প্রায় ৭ কিমি উত্তর-পশ্চিমদিকে ভাগিরথীর অপর পাড়ে প্রভু জগদ্বন্ধু জন্মভিটায় ১১৮ ফুট উঁচু এই মন্দিরটি। এটি ২০০০-২০০৩ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। জগদ্বন্ধু সুন্দর ছিলেন একজন বৈষ্ণব ধর্মগুরু, সমাজ-সংস্কারক ও লেখক। ১৮৭১ সালের ২৮ এপ্রিল (১৬ বৈশাখ ১২৭৮ বঙ্গাব্দ ) মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়ায় পিতার কর্মস্থলে তাঁর জন্ম। তাঁর মাতা বামাসুন্দরী দেবী। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে।
লোকবিশ্বাস মতে, নদীয়া থেকে শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীহট্ট যাত্রার পথে জগদ্বন্ধুর পূর্বপুরুষ বাসুদেব চক্রবর্তীর গৃহে অবস্থান করেছিলেন। বাসুদেব চক্রবর্তীর উত্তরপুরুষ ছিলেন রামনারায়ণ চক্রবর্তী। তাঁর দুই পুত্র - কৃষ্ণমঙ্গল ও কৃষ্ণকমল। কৃষ্ণমঙ্গলের পুত্রের নাম ছিল শম্ভুনাথ। তাঁর চারপুত্র- হবানন্দ, বাণীকণ্ঠ, ভৈরব, দীননাথ এবং দুই কন্যা- হরসুন্দরী, কাশীশ্বরী। কৃষ্ণকমলের একমাত্র পুত্রের নাম ছিল আরাধন। তিনি বিবাহিত হলেও সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। তাঁর ভক্তিভাবে খুশি হয়ে মুর্শিদাবাদের বড়নগরের রানী ভবানীর দত্তকপুত্র সাধক রামকৃষ্ণ আরাধনকে তাঁর সভাপণ্ডিত করেছিলেন। এদিকে সংসার জীবনে ফেরানোরর জন্য শম্ভুনাথ তাঁর পুত্র দীননাথকে আরাধনের হাতে অর্পন করেন। অত:পর আরাধন ভ্রাতৃপুত্র শিষ্যপ্রতীম দীননাথ ও কুলবিগ্রহ রাধাগোবিন্দ নিয়ে মুর্শিদাবাদের গঙ্গার তীরে (ডাহাপাড়ায়) আশ্রম স্থাপন করেন।
মন্দিরে প্রবেশ তোরণ |
আরাধন পন্ডিতের মৃত্যুর পর দীননাথ পৈতৃক নিবাস গোবিন্দপুরে ফিরে যান এবং বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। সেখানে বাংলা ১২৬৯ সালে গুরুচরণ নামে একপুত্র ও ১২৭২ সালে কৈলাসকামিনী নামে এক কন্যা লাভ করেন। কিন্তু মাত্র আট মাস বয়সে গুরুচরণ মারা যান। কন্যাসন্তান ও সহধর্মিণীকে নিয়ে মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ায় ফিরে আসেন দীননাথ। সেখানে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দ কুঞ্জ সংস্কার করে পুজা ও অধ্যাপনা কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি ডাহাপাড়ার বঙ্গাধিকারী ব্রজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সভাপণ্ডিত হন।
১৪ মাস বয়সে প্রভু সুন্দরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রভু সুন্দরকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর শহরের ব্রাহ্মণকান্দা গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্রাহ্মণকান্দার অদূরেই গোয়ালচামট শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন অবস্থিত। আধ্যাত্মিক জীবনের শেষার্ধে তিনি শ্রীধাম শ্রী অঙ্গনের একটি নির্জন কক্ষে দীর্ঘ ১৬ বছর ৮ মাস গম্ভীরালীলায় নিমগ্ন ছিলেন। বাংলা ১৩০৯ সালের আষাঢ় (১৯০৩ সালের জুলাই) থেকে বাংলা ১৩২৫ সালের মাঘ (১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত আলো-বাতাসহীন মাটির ঘরে তপস্যায় নিয়োজিত থাকার সংবাদ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে বাংলা ১৩২৮ সালের আশ্বিন মাসের ১লা তারিখে তিনি লীলাসংবরণ করেন।
প্রভু জগদ্বন্ধু |
প্রভু সুন্দরের মহাপ্রয়াণের পর থেকে তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও লীলাসঙ্গী আচার্য শ্রীপাদ মহেন্দ্রজী শ্রীঅঙ্গনে মহানাম সম্প্রদায় গঠন করেন। প্রভুর কৃপা নির্দেশে গঠিত এ মহানাম সম্প্রদায় বিশ্বকল্যাণার্থে বাংলা ১৩২৮ সালের ২ কার্তিক থেকে অখণ্ড মহানাম কীর্তন শুরু করেছে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। মহেন্দ্রজী কিছু সময়ের জন্য শ্রীমৎ কুঞ্জদাসকে স্বতন্ত্র প্রচারের দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে কুঞ্জদাস আরও কয়েকজন বান্ধব নিয়ে মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ায় প্রভু সুন্দরের জন্মভিটায় ন্যায়রত্নের শ্রীরাধাগোবিন্দের কুঞ্জ সংস্কার করে নিয়মিত মহানাম এবং প্রভু সুন্দরের জন্মোৎসব শুরু করেন।
প্রভু সুন্দরের দিব্য জীবনের দুটি দিক রয়েছে। একটি তার আধ্যাত্মিক দিক, অপরটি সমাজের পিছিয়ে পড়া বুনা, বাগদী, ডোম এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য বন্ধুরূপে প্রকাশ। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্যত্বহীন অধিকারবঞ্চিতদের মানুষের মর্যাদায় উন্নীত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
তাঁর রচিত বৈষ্ণব ধর্মীয় সঙ্গীত বা কীর্তন সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল - 'হরিকথা', 'চন্দ্রপাত', 'ত্রিকাল'।
{ তথ্যসূত্র : পর্যটনে মুর্শিদাবাদ - দীননাথ মণ্ডল, অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা }
{ তথ্যসূত্র : পর্যটনে মুর্শিদাবাদ - দীননাথ মণ্ডল, অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা }
Historical Structure
ReplyDeleteকোনো কনটাক্ট নং
ReplyDelete