বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্বপ্নের প্রাসাদটি হলো হীরাঝিল। মুর্শিদাবাদের অদূরে জাফরাগঞ্জের বিপরীতে ভাগীরথী নদীর ওপারে পশ্চিমতীরে নবাব সিরাজের সাধের প্রাসাদ হীরাঝিলটি ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পরবর্তীতে সর্বস্ব লুটপাটের পাশাপাশি ওই প্রাসাদটি ইংরেজরা ধ্বংস করে দেয়। বাকিটুকু স্রোতধারা ভাগীরথী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ভগ্ন চত্বরের কয়েকটি অংশ ছাড়া কোন চিহ্নই আর বিদ্যমান নেই। জানা যায়, মেসো ও মাসি নওয়াজিশ আহমদ ও ঘসেটি বেগম-এর সুরম্য হ্রদবেষ্টিত প্রমোদ কানন মোতিঝিল প্রাসাদের ঐশ্বর্য দেখে নবাবি পাওয়ার পূর্বেই সিরাজউদ্দৌলার ইচ্ছে হলো ভাগীরথী নদীর অপর পারে তিনি গড়বেন আরেক প্রাসাদ। নানা আলীবর্দী খাঁর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তিনি সেই ইচ্ছা পূরণ করলেন ১৭৪৬ সালে এবং প্রাসাদের নাম দিলেন হীরাঝিল।
হীরাঝিল প্রাসাদ তৈরির জন্য সিরাজ নবাব হওয়ার
বহু পূর্ব হতেই গৌড় হতে নানান প্রস্তরাদি এনেছিলেন। প্রাসাদের সন্নিকটে একটি ঝিল প্রস্তুত
করে তার চারদিকে নানারূপ প্রস্তর দ্বারা আবৃত করে ঝিলটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। হীরাঝিলটি
ভিন্ন ভিন্ন চত্বরে বিভক্ত ছিল- যা ভিন্ন ভিন্ন নামে অবহিত হতো। দিনের বেলা ও জ্যোৎস্না
রাতে ঝিলের জলে প্রাসাদের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্য বিস্তার লাভ
করতো। হীরাঝিল প্রাসাদকে মনসুরগঞ্জ প্রাসাদও বলা হয়ে থাকে, কারণ মনসুরগঞ্জ মৌজায় স্থাপিত
বলে। তখনকার লোকে বলতো লাল কোঠি। ঐ প্রাসাদের উত্তর দিকে ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবার
কক্ষ ও মসনদ। এই হীরাঝিল প্রাসাদ থেকেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে রওনা দিয়েছিলেন
এবং যুদ্ধে পরাজয়ের পর স্ত্রী লুৎফা ও শিশু কন্যাকে নিয়ে শেষবারের মতো হীরাঝিল প্রাসাদ
ছেড়ে গিয়েছিলেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা হীরাঝিল ছেড়ে গেলে বিশ্বাসঘাতক
সেনাপতি মীরজাফর প্রাসাদ দখল করেন। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন লর্ড ক্লাইভ হীরাঝিল দরবার কক্ষে
অবস্থিত মসনদে মীরজাফরকে নবাব হিসেবে হাত ধরে বসিয়ে দেন। হীরাঝিল প্রাসাদের কোষাগার
থেকে ওই সময় বিপুল পরিমাণ সোনা, রূপা, সোনার টাকা, হীরা, জহরত, চুনি, পান্না ইত্যাদি
ইংরেজরাসহ নবাবে সাথে বিশ্বাসঘাতকের দলেরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। মীরজাফর ইংরেজদের
অনুশাসনে পুতুল নবাব হলে ওই হীরাঝিল প্রাসাদে বহুদিন বসবাস করেছিল এবং তার সময় থেকেই
হীরাঝিলের পতন শুরু হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাধের হীরাঝিল প্রাসাদ আজ না থাকলেও দুই-একটি
চত্বরের ভিত্তিভূমি গভীর জঙ্গলে আচ্ছিদ্য হয়েও এখনো ওই প্রাসাদের স্থান নির্দেশ করে
দেয়। ঝোপঝাড় ও আগান-বাগানের মধ্যে প্রাসাদ চত্বরের ভিত্তিভূমি স্বাক্ষী হয়ে অবশিষ্ট
শেষ স্মৃতিরূপে আছে হীরাঝিল প্রাসাদ।
No comments:
Post a Comment