'সোঁদামাটি' সাহিত্য পত্রিকা ও 'ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ' ফেসবুক গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে এই ওয়েবসাইট।

ডুমনীদহ বিল : ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে

দীননাথ মণ্ডল
ডুমনীদহ বিল (Dumnidah bil) 
ভূ-প্রকৃতির বিবর্তন লীলা ও লোকায়ত জনশ্রুতি কখন যে মিলেমিশে ইতিহাস হয়ে যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত কাপাসডাঙা অঞ্চলের ডুমনীদহ বিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জনশ্রুতির অলৌকিক মাহাত্ম্য ও নদীর গতি পথের বিবর্তন ধারা বুকে নিয়ে আজও বিদ্যমান ডুমনীদহ বিল ও তার পারে অবস্থিত দেবী ডুমনী মায়ের মন্দির। দেবী ডুমনী মায়ের নাম থেকে ডুমনীদহ বিল এটি সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু ডুমনীদহ বিল সৃষ্টির ব্যাখ্যা দু-রকম।

   প্রচলিত জনশ্রুতি আছে যে, কোন এক সময় এক ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ জমিদারের পুত্র কালীকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নদী দিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মাঝিমাল্লা নিয়ে নৌকা যাত্রা করছিলেন। গ্রামগঞ্জ অতিক্রম করে এক নির্জন স্থানে নৌকা নৌঙর করে তারা। এমন সময় জঙ্গলে একাকী রূপ লাবণ্যে পরিপাট্য এক সুন্দরী যুবতীকে দেখতে পান কালীকিঙ্কর। যুবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন তিনি। অতপর গান্ধর্ব মতে সেখানে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এবার নৌকা নিয়ে দেশে ফেরার পালা। কিন্তু হঠাৎ বজ্রপাতসহ নেমে আসে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। অবিরাম বৃষ্টিতে নৌকার শুকনো জ্বালানী ও খাবার নষ্ট হয়ে যায়। পরদিন খিদের জ্বালায় মাঝিমাল্লা সহ জমিদার পুত্র কাতর হয়ে পড়ে। তখন সদ্য বিবাহিত নববধূ কাঁচা বাঁশ কেটে এনে তা থেকে চাঁচাড়ি বের করে আগুন জ্বেলে রান্না করে। নববধূর এই কাজ দেখে সন্দেহ জাগে জমিদার পুত্রের মনে। তার বিবাহিত স্ত্রী নিশ্চয় নীচকুলের যুবতী - জাতিতে ডোম হবে। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত নববধূকে ফেলে তারা নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘুম ভেঙে যুবতী কাঁদতে থাকে স্বামীর জন্য। কাঁদতে কাঁদতে অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে যায় সে। তার চোখের জলের গড়িয়ে পড়া ধারায় সৃষ্টি হয় ডুমনীদহ বিল। জাতিতে ডোমকন্যা ছিল তাই সে ডুমনী। এই যুবতী স্বামীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে একদিন শিলায় (পাথরে) রূপান্তরিত হয়।
     আবার ডুমনীদহ বিল সৃষ্টির ব্যাখ্যা ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে একটু স্বতন্ত্র। ডুমনীদহ বিল মুর্শিদাবাদ জেলার বাগড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। সমগ্র বাগড়ি অঞ্চলটি কোন এক সময় সমুদ্রের গর্ভে ছিল। কালক্রমে পলি জমে এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটির সৃষ্টি হয়। গঙ্গা নদী কোন এক সময় এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত। গঙ্গা নদী ক্রমে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকলে এই জলা অংশটি নদীর মূলগতি পথ থেকে বিচ্ছিন হয়ে যায়। গঙ্গা নদীর পরিত্যক্ত অ-ভরাট কিছু অংশ থেকে এই ডুমনীদহ বিলের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ডুমনীদহ বিলের জলা অংশের মোট আয়তন ৫৬ একর ১৩ শতক।
ডুমনীদহ বিল 
     পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ডুমনীদহ বিলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩.৫ কিমি। এই বিল শুরু হয়েছে পশ্চিমে আন্ডিরন গ্রাম থেকে পূর্বে কাজিসাহা ও কাপাসডাঙা গ্রামের সংযোগস্থলে শেষ হয়েছে। ডুমনীদহের বিলের উত্তরে আন্ডিরন, বেগুনবাড়ি, চকহিজুলী গ্রাম ও কাজিসাহা গ্রামের কিছু অংশ এবং দক্ষিণে নওপুকুরিয়া, কাপাসডাঙা গ্রাম অবস্থিত। রেজিনগর ও বেলডাঙা থানার ভাগিরথী নদী বাঁধের পূর্বদিকে বিশেষ করে ছেতানী, দাদপুর, মির্জাপুর, মহ্যমপুর, কুমারপুর, বড়ুয়া, সরুলিয়া, হরেকনগর, আন্ডিরন, বেগুনবাড়ি গ্রাম ও বেলডাঙা পৌরসভার বর্ষার জল এই বিলে গিয়ে পড়ে। সেখান থেকে কাপাসডাঙার পূর্বে নীচু মাঠ গড়িয়ে পাতবিলে নামে। ক্রমে জল মাঠ গড়িয়ে জলঙ্গি নদীতে পড়ে। এক সময় জলঙ্গি নদীর সঙ্গে সরাসরি ডুমনীদহ বিলের যোগাযোগ ছিল। বর্ষায় জলঙ্গি নদীর জলও ডুমনীদহে আসত। ক্রমশ মাঠ দিয়ে বয়ে চলা নালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
পুকুর পাড়ে ছিল বেগমবাটি রেশম কুঠি 
     এই ডুমনীদহ বিলের পাড়ে এক সময় গড়ে ওঠেছিল বেগমবাটি বন্দর। তখন নদী দিয়ে প্রবাহিত হত তীব্র স্রোত। সেই স্রোতে ভেসে আসত বজরা নিয়ে বাণিজ্য করতে সওদাগরেরা। চাঁদ সওদাগর নাকি এই বেগমবাটি বন্দরে তাঁর বাণিজ্য তরী বেঁধেছিলেন। অবশ্য এগুলি জনশ্রুতি। তবে বিলের দু-পাড়ে এক সময় প্রচুর পরিমাণে নীল ও রেশমের চাষ হত। ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা এখানে আসত বাণিজ্য করতে। বেগমবাটির বর্তমান নাম হয়েছে বেগুনবাড়ি। বেগুনবাড়ি গ্রামের মোহিষমারা পুকুরের পূর্বপ্রান্তে রেশমকুঠির ভাঙা চিমনী কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিল। কুঠিতে রেশমের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলত তখন। বেগমবাটি বাণিজ্য বন্দরের যথেষ্ট সুনাম ছিল।
     আন্ডিরন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অধীনে ডুমনীদহ বিলে মাছ চাষ হয়। কালো জল। বিলে সারাবছর জল থাকে। রুই, কাতলা, বাটা, পুটি, খয়রা, সিলভার কাপ, গ্লেলাস কাপ ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে মিঠাজলের মাছ এখানে চাষ করা হয়। তাছাড়া বর্ষার সময় বিভিন্ন এলাকার পুকুর ভাসা মাছ এসে জড়ো হয়। এখানকার মাছের স্বাদ অতুলনীয়, বাজারে চাহিদাও যথেষ্ট।
     শীত পড়তেই বিলে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা শুরু হত। পাখির ডানার ঝাপটা ও সুরের কলতান আকাশ-বাতাস মুখোরিত করে তুলত। সেসব অতীত কথা। এখন পরিযায়ীরা আর আসে না। চোরা শিকারির উৎপাতের কারণে তারা মুখ ফিরে নিয়েছে। সংস্কারের অভাবে কোথাও কোথাও জলজ আগাছা, শ্যাওলা ও কচুরিপানা নির্বিঘ্নে তাদের রাজত্ব বিস্তার শুরু করে চলেছে। ডুমনীদহের জল সেচ কাজে ব্যবহার করে সবুজ ফসলে উপচে পড়ছে চাষির ক্ষেত। সোনালি ফসল ঘরে তুলে আনে চাষি হাসি মুখে। সেই কবে থেকে এখনও পর্যন্ত এতটুকু কার্পণ্য নেই ডুমনীদহের। শত অত্যাচার বুকে নিয়ে সূর্যের রাঙা আলোয় দাঁত বের করে এখনও হাসে নীরবে ডুমনীদহ।
প্রাচীন বটবৃক্ষ 
     ডুমনীদহ বিলের পাড়ে নওপুকুরিয়া গ্রামে দেবী ডুমনী মায়ের মন্দির। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন একটি বিশাল বটবৃক্ষের নির্জনতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে মন্দিরটিকে। বটবৃক্ষের ঝুরি দেখে গাছটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে। ঝুরিগুলি এতই বড়ো যে গাছটির কোনটি কান্ড তা বোঝা যায় না। চারদিকে প্রাচীর দিয়ে মন্দির এলাকাটি ঘেরা। বটগাছে নীচে চাতাল সংলগ্ন একটি ঘরে দেবী ডুমনী মায়ের মূর্তি রয়েছে। এক চালি বিশিষ্ট প্রায় এক ফুট উচ্চতার দেবী ডুমনী মায়ের কোষ্টি পাথরের মূর্তি। দেবীর মাথার উপর চালিতে রয়েছে ধ্যানরত বুদ্ধমূর্তি। ডুমনী দেবীকে কেউ কেউ বলেন, বৌদ্ধ তারা। আবার অনেকে মনে করেন, তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। তবে যে যাই বলুক ভক্তেরা কিন্তু দক্ষিণা কালীর ধ্যানে পূজা করেন মা ডুমনীকে। ডুমনী মায়ের মূর্তির পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটি কালো কোষ্টি পাথরের বিষ্ণুমূর্তি ও একটি ভাঙা নারী মূর্তি এবং একটি সাদা বেলে পাথরের ধ্যানরত ডুমনী মায়ের মূর্তি। এই মূর্তিগুলি ডুমনীদহ বিলের জল থেকে পাওয়া গেছে। তবে কবে, কে বা কারা পেয়েছিল এবিষয়ে কেউ নিদিষ্ট করে বলতে পারে না। কোষ্টি পাথরে মূর্তিগুলি সেন বা পাল যুগের সমসাময়িক সময়ের হবে বলে গবেষকরা মনে করেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ডুমনী মায়ের বিশেষ পূজা উপলক্ষ্যে মুর্শিদাবাদ তথা জেলার বাইরে অনেক দূরদূরান্ত থেকে ভক্তের সমাগম হয়। তাছাড়া বৈশাখ মাসের শনি ও মঙ্গলবারগুলিতে একমাস ধরে মেলা বসে এখানে। ভক্তেরা পরম ভক্তিভরে ডুমনী মায়ের কাছে তাদের অভীষ্ট সিদ্ধির উদ্দেশ্যে মানোত করেন এবং পূজা দেন। মন্দিরে পাশেই আছে খেয়াঘাট- নওপুকুরিয়ার সঙ্গে ওপাড়ের আন্ডিরন গ্রামে যোগাযোগ প্রধান মাধ্যম।

ডুমনী মায়ের মন্দির 


ডুমনী মন্দিরে অবস্থিত মূর্তি



শেয়ার করুন

No comments:

Post a Comment